বাংলাদেশের মারমাগণ একটি সংখ্যালঘু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। প্রকৃতির লীলায় বেড়ে ওঠা মারমাগণ অরণ্যচারী। ‘প্রান্তীয় পরিস্থিতির কারণে তারা যেমন ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন তেমনি শিক্ষা, দীক্ষা ও আর্থ সামাজিক প্রেক্ষিতে পশ্চাৎপদ। তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বারটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে বর্মীভাষী মারমারা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী’ (মুস্তফা মজিদ। মারমা জাতিসত্ত্বা, ২০০৪, ১ম ফ্লাপ)। ‘এদের মধ্যে ত্রিপুরা নৃগোষ্ঠী ছাড়া বাকি এগারোটি জনজাতি আরাকানের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর অংশ’ (আবদুল হক চৌধুরী। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা উপজাতি, উপজাতীয় গবেষণা পত্রিকা, ১৯৯৪, পৃ , ২৬)। মারমারাও তাই।
বান্দরবানের বোমাং চীফ পরিবারের দাবি, তারা পেগু রাজ্যের তেলেইং রাজকুমার মংশোয়েপ্রুর উত্তর পুরুষ। আর মারমা নৃগোষ্ঠী হচ্ছে তাদের অনুগামী তেলেইং জাতির লোকজন। বোমাং চীফ পরিবারের এ দাবি অনেকেই মানতে চাননা। আবদুল হক চৌধুরীর যুক্তি হলো- ‘বোমাং, মগ বা মারমাদের মাতৃভাষা হলো আরাকানি উপভাষা। তারা যদি তেলেইং নৃ গোষ্ঠীর বংশধর হয় তাহলে তাদের মধ্যে তেলেইং ভাষা অনুপস্থিত কেন’? (আবদুল হক চৌধুরী। প্রাগুক্ত)।
ত্রিপুরার মগ জনগোষ্ঠী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমারা ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত হলেও ‘নৃতাত্বিক ও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে একই জাতিসত্ত্বার বিকাশের ধারায় প্রকাশিত, একই ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ, একই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরির্চচা, মিল- মিলন- সহবস্থানের যোগসুত্রে গাঁথা একই আলো, আবেগ, আবেদন; চিন্তা চেতনায় উদ্ভাসিত অভিন্ন এক জাতিসত্ত্বা’ (মংক্যা শোয়েনু নেভী। প্রসঙ্গ মারমা সমাজ ও সংস্কৃতি, সমুজ্জ্বল সুবাতাস, ২০০৮)।
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা ও তার সন্নিহিত অঞ্চলে আরাকানী ও বর্মী জনগণ মগ নামে অভিহিত হতো। এই নাম বা বিশেষণটি সুনাম - দূর্নাম উভয় বৈশিষ্টে মন্ডিত। ‘মগ শব্দের সাথে জলদস্যু পরিচয়ের যোগসুত্রের কারণে আজকাল বর্মী ও আরাকানী বংশোদ্ভুত লোকেরা এ নামে পরিচিত হতে কুণ্ঠাবোধ করে’ (চৌধুরী পূণ্যচন্দ্র দেববর্মা। চট্টগ্রামের ইতিহাস, ১৯২০, পৃ-১৬৭)।
চৌধুরী পূণ্যচন্দ্র দেববর্মা মারমাদের বিহার রাজবংশ উদ্ভুত বলে মনে করেন। মগধের কোন এক রাজবংশ ব্রাহ্মদেশে আধিপত্য বিস্তার করায় তাদের মগ নামে অভিহিত করা হয়। গ্রীয়ার্সনের ( ১৯০৯) মতে মগ শব্দটি ইন্দোচীন জনগোষ্ঠী থেকে গৃহীত। যদুনাথ সরকার তার হিস্ট্রি অব বেঙ্গল গ্রন্থে (পৃ-৩৮১) ফরাসী মুগ (অগ্নি উপাসক) শব্দ থেকে মগ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে উল্লেখ করেন।
‘মারমা শব্দটি মারমাজা বা ম্রাইমাজা নামের উপমহাদেশীয় প্রাচীন ব্রাহ্মী হস্তাক্ষর লিপি থেকে উদ্ভুত’ (বি. আর ফার্ণ। কিং বেরিং (অনুবাদ মোশতাক আহমদ), ঊর্মী, সম্পাদনা জাফার আহমাদ হানাফী, ১৯৯৬)। বি.আর. ফার্ণ (১৯৩৩) মনে করেন- মগ শব্দটি চট্টগ্রামের আরাকানি বাসিন্দাদের বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ মি. এ.ই. চন্দ মগ শব্দটির বিষয়ে বি.আর. ফার্ণ কে জানান ”মগ শব্দটি নিঃসন্দেহে বাংলাভাষা থেকে আগত, কিন্তু শব্দটির প্রকৃত তাৎপর্য এবং মৌল উদ্ভব সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট নয়। ‘তবে জনশ্রুতি আছে প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মের উৎপত্তি স্থলে যখন ব্রাহ্মণ্য ধর্র্মের উদ্ভব ঘটে তখন মগধ রাজপরিবারের একটি শাখা চট্টগ্রামে অভিবাসিত হয়। ফার্ণের ধারণা আরাকান রাজ পরিবার কোন না কোনভাবে বিহার রাজপরিবার সম্ভুত’ (অং সুই মারমা। মারমা ইতিহাসের উপর একটি অনুপঙ্খু আলোচনা, পইংজ্রা, বোমাং রাজ পূণ্যাহ স্মরনিকা, বান্দরবান, ১৯৯৪)।
বোমাং রাজা মং শৈ প্রু চৌধুরী ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সরকার প্রধানের প্রতি মারমাদের মগ আখ্যা দেয়া বিষয়ে আপত্তি জানান এবং ১৯৫১ সালের আদমশুমারীতে তাদের প্রকৃত জাতি পরিচয় মারমা তালিকাভুক্ত করার অনুরোধ জানান। আতিকুর রহমানের মতে, বোমাং চীফ ১৯৬৪ সালে বান্দরবান মহকুমা প্রশাসকের কাছে এক চিঠিতে জানান- মগ নয় মারমা নামই তাদের কাছে অভিপ্রেত (আতিকুর রহমান। গবেষণাকর্ম: পার্বত্য চট্টগ্রাম, ২০০০, পৃ- ৩৮)।
মারমাদের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরানো। তাদের প্রাচীন সভ্যতার নানান ইতিহাস ইতোমধ্যে আবিস্কৃত হয়েছে। ‘তাদের জাতিগত ঐতিহ্য ও কৃষ্টি যে একটি ধারাবাহিক পথ অতিক্রম করেছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা’ (মুস্তফা মজিদ। ২০০৪, প্রাগুক্ত)। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি ভিন্ন মাত্রার উপর প্রতিষ্ঠিত কিন্তু তাদের নিয়ে সুনির্দ্দিষ্ট কোন গবেষণা গ্রন্থ অদ্যাবধি প্রণীত হয়নি। ধারাবাহিক ও নির্ভরযোগ্য ইতিবৃত্ত আবিষ্কৃত না হওয়ায় তাদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া দুষ্কর। ব্রিটিশ আমলে কিছু সংখ্যক ইংরেজ ও স্থানীয় লেখক চাকমা, ম্রো ও ত্রিপুরার পাশাপাশি মারমাদের নিয়েও কিছু তথ্যনিষ্ঠ সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত রচনা করেছেন। এদের মধ্যে টি.এইচ.লুইন (১৮৭৯), আর. এস. এইচ হাসিনসন (১৯০৫) স্যার আর্থার প্রেইরি (১৯৩০), পিয়ের ব্যাসানেত (১৯৫৪), আবদুল হক চৌধুরী, আহমদ শরীফ, আবদুস সাত্তার, মাহবুবুল আলম।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন